হিন্দু বিবাহ সম্পর্কিত নিয়মাবলি আলোচনা করো। Discuss the nature of Hindu marriage.

By Nitish Paul

Published on:

nth

প্রশ্নঃ হিন্দু বিবাহ সম্পর্কিত নিয়মাবলি আলোচনা করো। Discuss the nature of Hindu marriage.

হিন্দু বিবাহ সম্পর্কিত নিয়মাবলি

 

বিশ্বের সমস্ত সমাজে বিবাহের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু না কিছু বিধিনিষেধ পাওয়া যায়। হিন্দু সমাজেও জীবনসাথী নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য বিবাহ সংক্রান্ত নিয়মকানুন রয়েছে। হিন্দু সমাজে অন্তর্বিবাহ ও বহির্বিবাহের নিয়ম দ্বারা জীবনসাথী নির্বাচন করা হয়। এখানে কিছু বিবাহের জন্য বিশেষ আজ্ঞা প্রদান করা হয়। এবং কিছু নিষেধ আরোপ করা হয়। এই সম্পর্কে ড: কাপাডিয়া লিখছেন জীবনসাথী নির্বাচনকে সীমিত করার জন্য হিন্দুদের মধ্যে অন্তর্বিবাহ এবং বহির্বিবাহ দু-প্রকার নিয়ম আছে। একথা স্পষ্ট করার জন্য প্রভু লিখছেন, “হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে জীবনসাথী নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য অন্তর্বিবাহ এবং বহির্বিবাহের কিছু নিয়ম নির্ধারিত করা হয়েছে।” ভারতবর্ষে হিন্দু বিবাহের সঙ্গে সম্পর্কিত এই নিয়মগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

 

(1) অন্তর্বিবাহ (Endogamy) – ধর্মশাস্ত্র অনুসারে অন্তর্বিবাহের সম্পর্ক হল নিজের বর্ণে বিবাহ করা, কিন্তু বর্ণের মধ্যে অনেক জাতি-উপজাতি পাওয়া যায়। তাই অন্তর্বিবাহ বর্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত না হয়ে জাতি এবং উপজাতির সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থাৎ সকলে নিজের জাতি বা উপজাতির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে। অন্য ভাবে বলা যায় অন্তর্বিবাহের তাৎপর্য হল নিজের গোষ্ঠীতে বিবাহ করা। এই গোষ্ঠী বিভিন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন রকম। হিন্দুদের মধ্যে জাতি অন্তর্বিবাহ (Caste Endogamy) এর প্রথা দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ সকল হিন্দু নিজের জাতিতেই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে। জাতির অর্থ বর্ণ দ্বারা বোঝা যায় না কারণ একই বর্ণে নানা জাতি-উপজাতি পাওয়া যায় যা অন্তর্বিবাহের বাস্তব unit। এইরূপ জীবনসাথী নির্বাচনের দৃষ্টিতে হিন্দু সমাজ অসংখ্য ছোট ছোট বৈবাহিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত।

 

  1. অন্তর্বিবাহের কারণ (Causes of Endogamy)- অন্তর্বিবাহের অনেক উপজাতিগত এবং সাংস্কৃতিক কারণ আছে। ভারতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠী এসেছে এবং তারা কোনো না কোনো বর্ণের সদস্যপদ লাভ করেছে। এই পরিস্থিতিতে উপজাতীয় মিশ্রণ বন্ধ করার জন্য অন্তবর্ণের বিবাহের ওপর বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে এবং অন্তর্বিবাহ-এর নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। লোকেরা নিজেদের গোষ্ঠীতেই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে শুরু করে। বিশেষত আর্য এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তের মিশ্রণ বন্ধ করার জন্য এরকম করা হয়েছে। বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভিন্নতা ছিল। এখানে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, বিভিন্ন বর্ণ অথবা স্ব-জাতীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সমস্যার সৃষ্টি করত। এই কারণে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ করতে শুরু করে এবং অন্তর্বিবাহী গোষ্ঠী দৃঢ় হতে থাকে। ধীরে ধীরে কর্মের জায়গায় জন্মের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রথমে কর্মের ভিত্তিতে ব্যক্তির শ্রেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হত কিন্তু পরে কর্মের জায়গা জন্ম নিয়ে নেয় এবং জন্ম অর্থাৎ রক্তের শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য অন্তর্বিবাহের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মে এই নীতির ধারণা পাওয়া যায়।

 

  1. বহির্বিবাহ (Exogamy)- বহির্বিবাহ এমন একটা নিয়ম যা অনুসারে ব্যক্তিকে নিজের গোষ্ঠীর বাইরে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। নিজের গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ করার আদেশ দেওয়া হয় না। এই গোষ্ঠী পৃথক পৃথক ব্যক্তির জন্য পৃথক পৃথক রকমের হতে পারে। হিন্দুদের মধ্যে বহির্বিবাহের নিয়ম অনুসারে ব্যক্তিকে নিজেরই জাতির কিছু বিশেষ গোষ্ঠী যেমন- গোত্র, প্রবর এবং পিণ্ড-এর লোকেদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করার আজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ভারতবর্ষের উপজাতিগুলির মধ্যে টোটেম বহির্বিবাহের নিয়ম দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ যাদের টোটেম এক তারা পরস্পরের মধ্যে বিবাহ করতে পারে না।

 

  • গোত্র বহির্বিবাহ (Gotra Exogamy) – গোত্র বিবাহের তাৎপর্য হল নিজের গোত্রের বাইরে বিবাহ করা। হিন্দু সমাজে সহগোত্র বিবাহ বর্জিত অর্থাৎ ব্যক্তি নিজেরই গোত্রের লোকেদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করার নিয়ম নেই। ড. অম্ভেকরের মতে- খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে সগোত্র বিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল না। পুরানেও এই ধরনের বিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেখতে পাওয়া যায় না। সগোত্র বিবাহের নিষেধ সম্পর্কে বুঝতে গেলে প্রথমে প্রয়োজন গোত্র শব্দের অর্থকে ভালভাবে জানা। সাধারণত গোত্র বলতে তাদেরই বোঝায় যাদের জন্ম একই পূর্বপুরুষ থেকে হয়েছে। বিশ্বামিত্র, যমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, অত্রি, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ এবং অগস্ত নামক আট ঋষিগণের সন্তানদের গোত্র নামে ডাকা হয়। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে গোত্রের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গোত্রের অর্থ সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট নয়।

 

  • সপ্রবর বহির্বিবাহ (Sapravar Exogamy) – গোত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত আর একটি ধারণা হল প্রবর। “বৈদিক ইন্ডেক্স”-এ প্রবর কথার অর্থ হল ‘আহ্বান করা’। কাপাডিয়ার মতে, প্রবর সংস্কার জ্ঞানের ঐ সম্প্রদায়কে সঙ্কেত করে যার সঙ্গে একজন ব্যক্তির সম্পর্ক থাকে। ‘প্রবর’ হল ব্যক্তির এমন একটি গোষ্ঠী যারা নিজেদের একে অপরের সঙ্গে আধ্যাত্মিক দিক থেকে অথবা রক্তের সম্পর্কের দিক থেকে সম্পর্কিত বলে মনে করে।

 

প্রাচীন কালে যজের আগুন জ্বালানোর সময় পুরোহিত নিজের শ্রেষ্ঠ ঋষি-পূর্বপুরুষদের নামোচ্চারণ করতেন। ‘যজমান’ ও পুরোহিত পূর্বপুরুষদের ঋষিদের সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত বলে মনে করত এবং এই ঋষিরা ছিলেন তাদের পূর্বপুরুষ। তারা নিজেদের একে অপরের সঙ্গে আধ্যাত্মিক দিক থেকে সম্পর্কিত বলে মনে করত। এই ধরনের ব্যক্তিদের গোষ্ঠীকে প্রবর বলা হত এবং একই প্রবরের লোকেরা পরস্পর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারত না।

 

 

  • সপিণ্ড বহির্বিবাহ (Sapinda Exogamy) – যেখানে সগোত্র এবং সপ্রবর বহির্বিবাহের বিধিনিষেধগুলি পিতৃপক্ষের লোকেদের পরস্পরের মধ্যে বিবাহের অনুমতি দেয় না, সেখানে সপিণ্ড বহির্বিবাহের বিধিনিষেধ মাতৃপক্ষের মেয়েদের সাথেও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের আজ্ঞা দেয় না। সপিণ্ড কথার অর্থ সমান পিণ্ড বা শরীর যুক্ত। সেই সকল ব্যক্তি যাদের মধ্যে একই সাধারণ স্ত্রী-পুরুষের রক্ত রয়েছে, তাদের সপিণ্ড বলা হয়। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে সপিণ্ড বিবাহ বর্জিত। যাজ্ঞবন্ধ্য স্মৃতির টীকাকার বিজ্ঞানেশ্বর বলেছেন যে সপিণ্ড এর অর্থ হল- একই শরীর বহনকারীদের মধ্যে সপিণ্ডতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পিতা এবং পুত্র হল সপিণ্ড কারণ পিতার শরীরের গঠন পুত্রের মধ্যে চলে আসে। এইরূপ দাদুর শরীরের গঠন পিতার মাধ্যমে নাতির মধ্যে চলে আসে, তাই তারা সপিণ্ড। মায়ের শরীরের অংশ পুত্রের মধ্যে এলে পুত্রের মার সঙ্গে সপিণ্ডতা গড়ে ওঠে। এইভাবে সপিণ্ড শব্দের প্রয়োগ করা হয়।

 

  • গ্রাম বহির্বিবাহ (Village Exogamy)- হিন্দু সমাজে বহির্বিবাহের এই তিনটি স্বরূপ ছাড়া উত্তর ভারতে কোথাও কোথাও গ্রাম বহির্বিবাহের নিয়ম দেখতে পাওয়া যায়। এই নিয়ম অনুসারে ব্যক্তির বিবাহ তার নিজের গ্রামে না হয়ে অন্য কোনো গ্রামে হতে পারে। গ্রামে জনসংখ্যা সীমিত থাকে সেখানে সকল জাতির লোক সাধারণত একই কুটুম্বিতার সম্পর্কে সম্পর্কিত। যদি সেখানে জাতি গোষ্ঠী থাকে তাহলে বেশি মাত্রায় সমান গোত্রের লোকই দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে নিকট আত্মীয় ও সপিণ্ডের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের সম্ভাবনা থাকে না সেখানে কিছু লোক গ্রামের বাইরে বিবাহ করা আবশ্যক বলে মনে করে। কোথাও কোথাও উপজাতিদের মধ্যে বহির্বিবাহের এই নিয়মকে খেড়া বহির্বিবাহও বলে।

 

  • টোটেম বহির্বিবাহ (Totem Exogamy)- ভারতীয় উপজাতিদের মধ্যে টোটেম বিবাহের প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। একটি সাধারণ টোটেম (প্রায়শই পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-চারাগাছ ইত্যাদি হয়)-এ বিশ্বাসী এবং এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিগণ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। নিজ টোটেম ছাড়া অন্য টোটেমের লোকেদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।

 

 

 

জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার

তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি

6295916282; 7076398606